বিজ্ঞানের সংজ্ঞা
বিজ্ঞান শব্দে ’বি’ উপসর্গটির অর্থ বিশেষ। অতএব বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ ’বিশেষ জ্ঞান’। তাই যে কোন তথ্য বা জ্ঞান-ই বিজ্ঞান নয়। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিযুক্ত চিন্তার মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি তাই হলো মূলত বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Science শব্দটি এসেছে লাতিন ভাষার ‘Scientia‘ থেকে, যার অর্থ হলো জ্ঞান বা সচেতনতা। বিজ্ঞান হলো একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া যা প্রকৃতি এবং সামাজিক ঘটনা বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, যা পরবর্তী গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রকারের বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা, যেমন বায়ু, জল, প্রাণী এবং মানব আচরণ ইত্যাদির দিকে দৃষ্টি দিতে পারি, ফলে আমরা সঠিক ধারণা তৈরি করতে পারি।
বিজ্ঞানের মৌলিক মুল্যবোধগুলোর মধ্যে রয়েছে পরীক্ষানিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং বোধবুদ্ধি। এ ছাড়া বিজ্ঞানে যুক্তিবিদ্যা এবং প্রমাণ সন্নিবেশিত হয়। বৈজ্ঞানিক থিওরি সাধারণত প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বিদ্যমান সকল তত্ত্ব দ্বারা সমর্থিত হয়। প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে; যেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান মূলত প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি নিয়ে কাজ করে, সেখানে সামাজিক বিজ্ঞান মানুষের আচরণ এবং সমাজের গঠন নিয়ে মনোনিবেশ করে।
বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া
বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের জন্য একদিকে যেমন দরকার ’বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া’ তেমনি দরকার একটি ’বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ ও মনোভাব। যেকোন উপায়ে বা প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানের জ্ঞান পাওয়া যেতে পারে। তবে, বিজ্ঞানের জ্ঞান যেন বিজ্ঞানসম্মত বা ত্রুটিমুক্ত ও সঠিক হয় সেজন্য কিছু প্রক্রিয়া বা ধাপ অনুসরণ করা হয়।
প্রশ্ন/ সমস্যা নির্ধারণ > বিদ্যমান তথ্য সংগ্রহ > সম্ভাব্য ফলাফল > উপাত্ত ও উপকরণ সংগ্রহ > পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও উপাত্ত সংগ্রহ > বিশ্লেষণ > সম্ভাব্য ফলাফল গ্রহণ বা বর্জন > ফলাফল প্রকাশ।
বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া হল একটি পদ্ধতিগত পন্থা যা পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, পরীক্ষণ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন তথ্য আহরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রথম পর্যায় হল পর্যবেক্ষণ। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পরিবেশ, ঘটনা বা সমস্যার দিক নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোন বিজ্ঞানী একটি নতুন প্রাকৃতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন, তবে তিনি সেই ঘটনা সম্পর্কে সম্ভাব্য কারণ এবং প্রভাবের নির্দেশনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
পরবর্তী পর্যায় হল গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তথ্য এবং আগে অবস্থিত তত্ত্বগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করে বই, জার্নাল এবং অন্যান্য গবেষণা উপকরণের বিশ্লেষণ। এই পর্যায়ে দেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, পূর্ববর্তী গবেষণাগুলির ফলাফল এবং তথ্য ভূমিকা রাখতে পারে নতুন বিশ্লেষণ এবং গবেষণার জন্য। গবেষণা করলে বিজ্ঞানীদের সামনে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে পরীক্ষণের দিকে মনোযোগ দেয়।
তৃতীয় পর্যায় হল পরীক্ষণ। এখানে বিজ্ঞানীরা পরিকল্পিত পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের সংরক্ষিত তথ্য যাচাই করতে চান। এটি বোঝায় যে, তাদের তত্ত্ব এবং অনুমানগুলি বাস্তবে কতটা যৌক্তিক এবং কার্যকর। পরীক্ষণের ফলাফলগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ফলাফলগুলি সমর্থক এবং বিরোধী উভয় পদ্ধতির মধ্যে তফাৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সবশেষে, বিশ্লেষণ পর্যায়ে পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা তথ্যের গুণমান এবং সঠিকতা যাচাই করে এবং নতুন তথ্যের ভিত্তিতে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বিজ্ঞানের প্রকারভেদ
বিজ্ঞান বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত, প্রতিটি শাখার বিশেষত্ব এবং প্রয়োগের ক্ষেত্র ভিন্ন। বিজ্ঞানকে প্রধানত তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত করা যায়:
পদার্থবিদ্যা
রসায়ন এবং
জীববিজ্ঞান
পদার্থ বিদ্যা:
পদার্থবিদ্যা হল বিজ্ঞানের সেই শাখা যা পদার্থ ও শক্তির বৈশিষ্ট্য এবং আচরণকে অধ্যয়ন করে। এটি মহাবিশ্বের মৌলিক নীতিমালা যেমন গতি, বল, তাপ, আলো এবং শক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রদান করে। পদার্থবিদ্যা বিভিন্ন প্রযুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।
রসায়ন বিদ্যা:
রসায়ন হল বিজ্ঞানের সেই শাখা যা পদার্থের রসায়নিক গঠন, গুণাবলি, এবং রসায়নিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। রসায়নের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন পদার্থের মৌলিক উপাদান ও তাদের সংযোগের সূত্র পেতে পারি। এটি আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য উৎপাদনে। এক্ষেত্রে, রসায়ন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি নতুন পদার্থ সৃষ্টি এবং পুরাতন পদার্থ পরিবর্তনে সাহায্য করে।
জীববিজ্ঞান:
জীববিজ্ঞান হল বিজ্ঞানের মূল যা প্রজাতির জীবন, তার গঠন এবং জীবন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। এটি জীবদেহ ও তাদের পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং বিবর্তনের নীতিমালা বোঝাতে সাহায্য করে। জীববিজ্ঞান বিদ্যা যেমন চিকিৎসা, কৃষি এবং ইকোলজি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক বিজ্ঞানও বিস্তৃত হয়েছে, যা মানব সমাজের কাঠামো ও কাজকর্মের অধ্যয়ন করে।