বিশ^সভ্যতা
আদিম যুগে মানুষ কৃষিকাজ জানত না। বনে বনে ঘুরে ফলমূল প্রভৃতি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে জীবন-ধারণ করত তারা। কালক্রমে মানুষ পাথরের হাতিয়ার তৈরি করতে শিখে এবং এক পর্যায়ে আগুনের ব্যাবহারও আবিষ্কার করে ফেলে তারা। নিজেদের প্রয়োজনেই প্রাচীন কাল থেকে দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করত মানুষ এবং এক পর্যায়ে এসে নদীতিরে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তোলে; নির্মাণ করে ঘর-বাড়ি এবং এভাবেই শুরু হয় মানব সভ্যতার।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
০১. পাথর যুগের প্রথম পর্যায়কে বলা হতো-
পুরনো পাথরের যুগ বা পুরোপলীয় যুগ।
০২. কৃষিভিত্তিক পাথর যুগকে বলা হয়-
নবোপলীয় যুগ বা নতুন পাথরের যুগ।
মিশরীয় সভ্যতা:
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠে মিশরীয় সভ্যতা। মিশরীয় সভ্যতার বিকাশে নিলনদের ভ’মিকা অসামান্য। তাইতো ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস মিশরকে বলেছেন নীল নদের দান। প্রাথমিক পর্যায়ে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩২০০ অব্দ পর্যন্ত দুটি অংশে উত্তর মিশর (নিন্ম মিশর) ও দক্ষিণ মিশর (উচ্চ মিশর) নিয়ে মিশরীয় সভ্যতার সূত্রপাত হয়। এই সময়টাকে মিশরের ইতিহাসে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলে।
পরবর্তীতে খিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে, নিন্ম ও উচ্চ উভয় মিশরকে একত্রিত করে নারমার বা মেনেস হন মিশরের প্রথম নরপতি, পুরোহিত বা প্রথম ফারাও।
ভৌগোলিক অবস্থান: এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ দ্বারা বেষ্টিত দেশটির উত্তরে ভ’মধ্যসাগর, পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভুমি, দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।
মিশরীয় সভ্যতার সময়কাল: মিশরীয় সভ্যতা ২৫০০ বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। মেনেসের নেতৃত্বে গোড়াপত্তনের পর প্রায় তিন হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জল ছিল মিশরীয় সভ্যতা। পরবর্তীতে খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতী মিশর দখল করে নেয়। ৬৭০-৬৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরের সিংহাসন দখল করে নেয় এবং ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার যবনিকাপাত ঘটে।
মিশরের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা: প্রাক রাজবংশীয় যুগে মিশর ’নোম’ নামক কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। মিশরের প্রথম ফারাও মেনেস বা নারমার ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে। মেনেসের রাজধানী ছিল মেম্ফিস। তখন থেকে মিশরে রাজবংশ তথা ফারাওদের শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। মিশরীয় ’পের-ও’ শব্দ থেকে ফারাও শব্দের উৎপত্তি। ফারাওরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিল এবং তারা নিজেদের সূর্যদেবতার বংশধর মনে করত।
উর্বর নীল নদের তীরে মিশরের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষি নির্ভর। পেশার উপর ভিত্তি করে মিশরের সমাজে কয়েকটি শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। যেমন-রাজপরিবার, পুরোহিত, অভিজাত, লিপিকার, ব্যবসায়ী, শিল্পি এবং কৃষক ও ভ’মিদাস। মিশরে উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ছিল গম, যব, তুলা ইত্যাদি।
মিশরীয়রা জড়বস্তুর পূজা করত। মূর্তি পূজা আর জীবজন্তুর পূজাও করত তারা। মিশরীয়রা বিশ^াস করত সূর্যদেবতা ’রে’ বা ’আমন রে’ এবং প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীলনদের দেবতা ’ওসিরিস’ সন্মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালনা করে। তাদের জীবনে সূর্যদেবতা ’রে’- এর গুরুত্ব অনেক ছিল বেশি।
মিশরীয়রা মনে করত মানুষ মৃত্যুর পর একদিন আবার বেঁচে উাঠবে তাই মৃত দেহকে তাজা রাখার জন্য মমি করে রাখত এবং মমি সংরক্ষণের জন্য তারা পিরামিড তৈরি করেছিল। মিশরের সবচেয়ে বড় পিড়ামিড ফারাও খুফুর পিরামিড।
ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয়দের জুরি মেলা ভার। মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গিজার স্ফিংক্স। স্ফিংক্স হচ্ছে এমন একটি ভাস্কর্য যার দেহটা সিংহের কিন্তু মুখ মানুষের।
মিশরীয়রা ২৪টি ব্যঞ্জনবর্নের ’হায়ারোগ্লিফিক’ নামক চিত্রলিপি উদ্ভাবন করেছিল। তারা কাগজ বানিয়ে কাগজের উপর লিখত। গ্রীকরা এই কাগজের নাম দেন ’প্যাপিরাস’ এবং এই ’প্যাপিরাস’ শব্দ থেকেই পেপার শব্দের উৎপত্তি।
মিশরীয়রা জ্যামিতি ও পাটিগণিতের ব্যাবহার আয়ত্ত করেছিল। তারা যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। মিশরীয়রা সৌর পঞ্জিকা আবিস্কার করেছিল। ৩৬৫ দিনে বছর এ হিসাবও আবিস্কার করেছিল মিশরীয়রা।
সিন্ধু সভ্যতা:
হরপ্পা সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা খ্যাত সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদের অববাহিকায়। বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো শহরের উঁচু ঢিবি খননের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায়। একই সময়ে ১৯২২-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারাম সাহানীর নেতৃত্বে পাঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলার হরপ্পা নামক স্থানেও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্র্তীতে জন মার্শালের নের্তৃত্বে খনন কার্য সম্পন্ন করা হয় এবং অনেক পুরাতত্ত্ব আবিস্কৃত হয়।
সিন্ধু সভ্যতায় আবিস্কৃত শহরগুলোর মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সবচেয়ে বড় শহর। শহরের বাড়িঘর পোড়া মাটি বা রোদে পোড়ানো মাটি দিয়ে তৈরি।
সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। এছাড়াও তারা পশুপালন, মৃৎপাত্র, অলংকার নির্মাণ, বয়ন শিল্প ও পাথরের কাজে পারদর্শী ছিল।
সিন্ধু সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পরিবারগুলো ছিল একক পরিবার। নারীদের পাশাপাশি পুরুষেরাও অলংকার ব্যবহার করত।
সিন্ধুর অধিবাসিদের ধর্মীয় জীবন বা ধর্মীয় বিশ^াস সর্ম্পকে তেমন কোন ধারনা পাওয়া যায় নি। তবে অসংখ্য নারী মূর্তি আবিস্কৃত হয়েছে সিন্ধু সভ্যতায়। তা থেকে অনুমান করা হয় তারা নারী মূর্তির পূজা করত।
সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা কুমারের মাটির চাকার সাহায্যে সুন্দর মাটির পাত্র বানাতে পারত। তারা দ্রব্যের ওজন পরিমাপ করতে জানত এবং তারা দাগ কাটা স্কেল ব্যবহার করেছিল। সিন্ধুর অধিবাসীরা ধাতুর সাহায্যে অস্ত্র, অলংকার তৈরি করত এবং তারা তামা ও টিনের মিশ্রণে ব্রোঞ্জের ব্যবহারে পারদর্শী ছিল।
গ্রীক সভ্যতা