November 21, 2024 6:21 am

মৃত্যুদন্ডের ২৪১৫ বছর পর নির্দোশ প্রমাণ ।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক :

পশ্চিমা দর্শনের  জনক হিসেবে খ্যাত জ্ঞানসাধক সক্রেটিস ছিলেন এবাধারে দার্শনিক, গবেষক এবং মহান শিক্ষক ।  জ্ঞান- বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ছিল তার অগাধ পান্ডিত্য। এই মহান দার্শনিক লিখিত কোন সৃষ্টিকর্ম বা নিজের সম্পর্কে লিখিত কোন তথ্য রেখে যান নি। তার সম্পর্কে যতটুকু লিখিত তথ্য পাওয়া যায় তা হলো তার শিষ্য প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‌‘ডায়ালগ’, সৈনিক জেনোফনের রচনা এবং কিছু ক্ষেত্রে এরোস্টোফেনিসের নাটকগুলো থেকে । 

আরাধ্য দেবতাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সক্রেটিস এবং তৎকালীন শাসকদের রোষানলে পড়ে এই মহান  দার্শনিককে হেমলক পাতার বিষপানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

সক্রেটিস এমন একটি দর্শন ধারার সূচনা করেছিলেন তা পরবর্তি  ২০০০ বছর পযর্ন্ত পাশ্চাত্য দশত্য , রাষ্ট্র- ব্যবস্থা , নৈতিকতা, সংস্কৃতি , তথা সভ্যতাকে বিশদভাবে  প্রভাবিত করেছিল। এমনকি বর্তমান আধুনিক  সময়ে  জ্ঞান –বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্রেটেশীয় ভাবধারার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট প্রয়িতমান। সক্রেটিস ছিলেন একজন মহান শিক্ষক তথা গুরু তার নির্দিষ্ট কোন শিক্ষায়তন ছিল না এবং শিক্ষাদানের বিনিময়ে তিনি অর্থ গ্রহণ করতেন না। তিনি ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির মাঝে যাকে যেখানে পেতেন বা তার শিস্যদের মাঝে তার দর্শনচিন্তা , দার্শনিক আদর্শ ও মূল্যবোধ আলোচনা করতেন।

সক্রেটিসের জীবনী :

মহান দার্শনিক সক্রেটিস ৪৬৯ মতান্তরে ৪৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইউরোপের দেশ গ্রিসের এথেন্স নগরিতে এলোপাকিগোত্রে জন্মগ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে বিরোধ তথা  রাজনৈতিক বিরোধের জেরে ৩৯৯ খিস্টপূর্বাব্দে তাকে হেমলক পাতার বিষপানে বিষপানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

প্লেটোর রচনা হতে জানা যায় সক্রেটিসের পিতার নাম ‌সফ্রোনিস্কাস’ এবং মাতার নাম  ফিনরিটি । তার পিতা পেশায় ছিলেন একজন নামী ভাস্কর  এবং তার স্ত্রীর নাম ছিল ‌জানথিপি’ । সংসার জীবনে সক্রেটিস তিন পুত্র সন্তানের জনক হন এবং তাদের নাম ছির লামপ্রোক্লিস , সফ্রোনিস্কাস এবং মেনেজনাস ।

সক্রেটিসের শারিরীক সৌন্দয্য :

যদি তৎকালে মহিলাদের  না বরং পুরুষদের সৌন্দয্য বিবেচনা করা হত, দু:খজনক  ভাবে সক্রেটিস  মোটেই সুদর্শন ছিলেন না। তার নাম ছিল চ্যাপ্টা,টাকযুক্ত মাথা , ছোট ছোট চোখ , স্ফীত উদর এবং গতিভঙ্গি ছিল অস্বাভাবিক । তবে দেহে র শ্রী না থাকলেও তার রসবোধ ছিল প্রখর ।

সক্রেটিসের পেশা ও আর্থিক দু:রবস্থা:  

সক্রেটিসের  পেশা সম্পর্কে বিশদ কিছু জানা যায় নি তবে প্রথম  জীবনে তিনি পিতার পেশা গ্রহণ করেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু সূত্র অনুযায়ী তিনি শিক্ষার বিনিময়ে টাকা নিতেন বলা থাকলেও প্লেটোর বর্ণনামতে তিনি কোনো পেশা গ্রহণ করেন নি এবং কখনোই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নিতেন না। সোফিস্টদের মতেও তিনি শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থগ্রহণকে ঘৃনা করতেন এবং সক্রেটিসের উক্তিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।  প্লেটোর ডায়ালগগুলোর থেকে জানা যায় রাষ্ট্রের নিয়মানুযায়ী তিনি কোনো সময়ে সোনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সফলতার সাথে সৈনিক জীবন শেষ করেন। স্বভাবতই তিনি অর্থকরি এবং জীবন- জীবিকা সর্ম্পকে ছিলেন উদাসীন এবং ফলস্বরুপ জীবনের  শেষ সময় তার অনেক অভাব অনটনের মধ্যে কাটে। অধিকাংশ সময় সক্রেটিস তার শিষ্যদের বাড়িতে খেতেন এবং স্ত্রীর কাছে তিনি ছিলেন এক অপদার্থ স্বামী । তাদের দুরি:বস্থার কারণে স্ত্রী জানথিপি সক্রেটিসকে দায়ী করলেও তিনি দার্শনিক স্বামীকে অনেক ভালোবাসতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড:

 তৎকালীন গণপ্রতান্ত্রীক  শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা ও সমাচেলাচনা করতে গিয়ে

সক্রেটিস শাসকগোষ্ঠীর সাথে বিরোধে জরিয়ে পরেন এবং অন্যদিকে ছিল তার অগাধ প্রজ্ঞার প্রতিহিংসা । ফলস্বরুপ তৎকালীন এথেনিয় সরকার সক্রেটিসকে এমন দোষে দোষি স্যাবস্ত করেছিল যাতে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় । মূলত তরুন সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুনীর্তি প্রবেশ করানোর অভিযোগ আনা হয় মহান দার্শনিক সক্রেটিসের বিরুদ্ধে।

৩৯৯ খ্রিষ্টপূবাব্দে ৫০০ জন মতান্তরে ৫০১ জন জুরির সমন্বয়ে জুরিবোর্ড গঠন করেন সক্রেটিসের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। সক্রেটিস নিজের যুক্তিতে অনড় ছিলেন এবং দোষ স্বীকার করেন নি। ২২১ জন বিচারক সক্রেটিসের পক্ষে মত দিলেও  ২৮০ জন বিচারক তাকে দোষী স্যাবাস্ত করেন এবং হেমলক পাতার বিষপানে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। মহান দার্শনিক সক্রেটিস আদালতের রায় স্বীকার করেন। একটি ধমীয় অনুষ্ঠানের কারণে তার মৃত্যুদন্ড ৩০ দিন পেছানো হয় এবং এ সময়ের মধ্যে মৃত্যু আগে তাকে পালানোর  সুযোগ করে দেওয়া হলেও তিনি কারাগার থেকে পালাতে অস্বীকার করেন। সত্য ও  জ্ঞানের প্রতি অবিচল এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল  থেকে নিজেকে নিদোষ জেনেও স্বেচ্ছায় হেমলক পাতার রস গ্রহণ করে চীরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পরেন মহান দার্শনিক সক্রেটিস ।

২৪১৫ বছর নির্দোষ প্রমাণ:

এদিকে মৃত্যুদন্ড কায্যকরের ২৪১৫ বছর পর একটি মামলার প্রেক্ষিতে গ্রিসের আদালত সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন মর্মে রায় দেয়। মূলত তিনি সত্যিই দোষি ছিলেন কিনা সেই সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়ার জন্য এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালত ফের নতুন করে সক্রেটিসের বিচার আয়োজন করা হলে আদালত সক্রেটিসকে  সম্পূর্ন র্নিদোষ বলে রায় দেয়।
এমনকি ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের একটি অাদালত সক্রেটিসকে নিদোষ ঘোষনা করে।

সক্রেটিসের উক্তি:

১. নিজেকে‌ জানো ।

২. যৌবনকালে অর্ধেক খাও, আর অর্ধেক সঞ্চয় করো যৌবনের সঞ্চয় বৃদ্ধকালের অবলম্বন ।

৩. সত্যিকারের  জ্ঞানী হবার প্রক্রিয়াটি তখনই শুরু হবে যখন আপনি জানকেবন যে আপনি কিছুই জানেন না।

৪. যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মতো ,যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়ষার জালের মত।

৫. গভীর আকাঙ্খা থেকে প্রায়শই মারাত্নক ঘৃনা আসে ।

৬। টাকার বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভাল।

৭। আমি কাউকে কিছু শিক্ষা দিতে পারবো না, আমি শুধু তাদের  চিন্তা করাতে পারবো।

৮.নারী জগতে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙ্গনের  সবশ্রেষ্ঠ উৎস । সে বৃক্ষের ন্যায় যা বাহ্যত সুন্দর দেখায়। কিন্তু চড়ুই পাখি ইহা ভক্ষণ করলে মৃত্যু অনিবায।

৯. যাই হোক বিয়ে করো। তোমার স্ত্রী ভালো হলে তুমি হবে সুখি, আর খারাপ হলে হবে দার্শনিক।

১০. বন্ধুত্ব কারো ধীরে ধীর , কিন্তু যখন বন্ধুত্ব হবে এটা দৃঢ করো এবং স্থায়ী করো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *