নৈতিকতা (Morality):
নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Morality‘ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Moralitas‘ থেকে, যার অর্থ ’সঠিক আচরণ বা চরিত্র’। রোমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণ অর্থে ‘Mas‘ শব্দটি ব্যবহার করতেন। ল্যাটিন এই Mas শব্দ থেকেই Morals ও Morality (নৈতিকতা) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।
নৈতিকতার সংজ্ঞা:
Collins English Dictionary -তে নৈতিকতা সর্ম্পকে বলা হয়েছে, “ Morality is concerned with on negating to human behavior, esp. the distinction between good and bad and right and wrong behaviour.”
জোনাথান হেইট -এর মতে, “ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ এই তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।”
নীতিবিদ ম্যুর বলেছেন, “শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।”
নৈতিকতা হলো একটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যাপার। নৈতিকতার উপরে রাষ্ট্রের সমর্থন বা কর্তৃত্ব থাকে না। এজন্য ম্যাকাইভার বলেছেন, “Law does not and can not cover all grounds of morality.”
সর্ম্পকিত প্রশ্ন:
১। নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় কী? [৩৫তম বিসিএস]
ক) মানুষের আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান
খ) মানুষের জীবনের সফলতার দিকগুলো আলোচনা
গ) সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা
ঘ) সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণের আলোচনা ও মূল্যায়ন
উত্তর: সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণের আলোচনা ও মূল্যায়ন
২। মানুষের কোন ক্রিয়া নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়? [৩৫তম বিসিএস]
ক) ঐচ্ছিক ক্রিয়া খ) ইচ্ছা নিরপেক্ষ ক্রিয়া
গ) অনৈচ্ছিক ক্রিয়া ঘ) ক ও গ নামক ক্রিয়া
উত্তর: ঐচ্ছিক ক্রিয়া
৩। একজন যোগ্য প্রশাসক ও ব্যবস্থাপকের অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক গুণাবলির শ্রেষ্ঠ গুণ কোনটি? [৩৭তম বিসিএস]
ক) দায়িত্বশীলতা খ) নৈতিকতা
গ) দক্ষতা ঘ) সরলতা
উত্তর: নৈতিকতা
৪। নৈতিক শক্তির প্রধান উপাদান কী? [৩৭তম বিসিএস]
ক) সততা ও নিষ্ঠা খ) কর্তব্যপরায়ণতা
গ) মায়া ও মমতা ঘ) উদারতা
উত্তর: সততা ও নিষ্ঠা
মূল্যবোধ কি?
মূল্যবোধ পৌরনীতি ও সুশাসনের একটি বিমূর্ত বিষয়। মানুষের যে সকল ধারণা, চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সংকল্প দ্বারা তার সামগ্রিক আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তার সমষ্টিই হলো মূল্যবোধ। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-আচরণ, ব্যবহার, কর্মকাণ্ড যে সকল নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।
মূল্যবোধের সংজ্ঞা:
এইচ. ডি. স্টেইন -এর মতে, “জনসাধারণ যার সম্বন্ধে আগ্রহী, যা তারা কামনা করে, যাকে তারা অত্যাবশ্যক বলে মনে করে, যার প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা বর্তমান এবং যা সম্পাদনের মাধ্যমে দ্বারা তারা আনন্দ উপভোগ করে তাকেই মূল্যবোধ বলে।”
এম. আর. উইলিয়াম -এর মতে, “মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। এর আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতি-নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই মানদণ্ডে সমাজে মানুষের কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।”
এফ. ই. মেরিল -এর মতে, “ সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে বিশ্বাসের এক প্রকৃতি বা ধরণ, যা গোষ্ঠিগত কল্যাণে সংরক্ষণ করাকে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।”
মূল্যবোধের প্রকারভেদ:
সামাজিক মূল্যবোধ:
যে ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড ও ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে।
সামাজিক মূল্যবোধের উদাহরণ:
সৌজন্যবোধ, সহমর্মিতাবোধ, সহনশীলতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, শিষ্ঠাচার, শৃঙ্খলাবোধ, সুকুমার বৃত্তি ইত্যাদি।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ:
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে সকল ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য দ্বারা মানুষের গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড ও ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। উদাহরণ: পরমত সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ, গঠণমূলক সমালোচনা করা ও সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা, সংয়ম, অধিকার ও কর্তব্য সচেতন, নির্বাচনের জয় পরাজয় মেনে নেওয়া, আইনসভাকে কার্যকর রাখা প্রভৃতি।
রাজনৈতিক মূল্যবোধ:
যে ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য দ্বারা মানুষের রাজনৈতিক আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তাকে রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলে।
রাজনৈতিক মূল্যবোধের উদাহরণ:
রাজনৈতিক সততা, রাজনৈতিক সহনশীলতা, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ, নির্বাচনের জয়-পরাজয় মেনে নেওয়া, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান না করা, জবাবদিহিতার মনোভাব।
অর্থনৈতিক মূল্যবোধ:
যে সকল কাজ-কর্ম, বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি দ্বারা মানুষের অর্থনৈতিক আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তাকে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ বলে। যেমন: ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, আর্থিক লেনদেন, শিল্পকারখানায় উৎপাদন ও বিপণন ইত্যাদি।
ধর্মীয় মূল্যবোধ
যে সকল ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দ্বারা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে। ধর্মীয় মূল্যবোধের উদাহরণ: সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, অপরের ধর্মমত সহ্য করা, অন্য ধর্মাবলম্বিদের ধর্ম-কর্মে বা প্রচারণায় বাধা প্রদান না করা।
আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ:
সৎভাবে বাঁচা, সৎ থাকা, সৎ মানুষকে পছন্দ করা, অসৎ মানুষকে অপছন্দ করা, মিথ্যাবাদী ও অসৎ মানুষকে ঘৃণা করা এবং ভালো কাজ করতে পারলে মনে তৃপ্তিবোধ করা হলো আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অংশ।
মূল্যবোধের উপাদান:
সহনশীলতা
শৃঙ্খলাবোধ
সামাজিক ন্যায়বিচার
নীতি ও ঔচিত্যবোধ
সহমর্মিতা
আইনের শাসন
শ্রমের মর্যাদা
নাগরিক সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ
সরকার ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখিতা
সরকার ও রােষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা
মূল্যবোধের বৈশিষ্ট:
১। সামাজিক মাপকাঠি: মূল্যবোধ মানুষের ভালো-মন্দ, আচার-আচরণ, চাল-চলন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার মাপকাঠি।
২। বিভিন্নতা: দেশ, জাতি, সমাজ বা স্থান, কাল, পাত্র ও প্রকৃতিভেদে মূল্যবোধ পরিবর্তিত হতে পারে।
৩। যোগসূত্র ও সেতুবন্ধন: মূল্যবোধ সমাজের মানুষকে ঐক্যসুত্রে আবদ্ধ করে।
৪। নৈতিক প্রাধান্য: মূল্যবোধ কোন আইন নয় বরং একটি সামাজিক নৈতিকতা।
৫। বৈচিত্রময় ও পরিবর্তনশীল: মূল্যবোধ আপেক্ষিক, বৈচিত্রময় ও পরিবর্তশীল।
সুশাসন (Good Governance)কি:
সুশাসনের (Good Governance) ধারণাটি বিশ্বব্যাংক কতৃক উদ্ভাবিত একটি ধারণা। শাসন শব্দটির সাথে ’সু’ প্রত্যয় যোগ করায় এর অর্থ দাড়ায় নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন।
বিশ্বব্যাংক ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম উন্নয়নশীল দেশের অনুন্নয়ন চিহ্নিত করার জন্য এক সমীক্ষায় সুশাসন প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংক সুশাসনের চারটি প্রধান স্তম্ভ তুলে ধরেন। এ চারটি স্তম্ভ হলো:
১. দায়িত্বশীলতা
২। স্বচ্ছতা
৩। আইনি কাঠামো
৪। অংশগ্রহণমূলক
সুশাসনের সংজ্ঞা:
বিশ্বব্যংক -এর মতে, “সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে উন্নয়নের লক্ষে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়।”
UNDP -এর মতে, “ Good Governance is the exercise of Economic, Political and Administrative authority to manage a country’s affairs at all levels.”
ম্যাককরনী -এর মতে, ”সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সর্ম্পককে বোঝায়।”
সর্ম্পকিত তথ্য:
সুশাসন শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ- Good Governance
সুশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো: মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণ।
সুশাসন ধারণাটির উদ্ভাবক- বিশ্বব্যাংক।
”সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশিল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সর্ম্পক বোঝায়”- ম্যাককরনি।
সুশাসনের পূর্বশর্ত হলো- মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
শাসন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ- Governance
E- Governance এর পূর্ণরুপ – Electronic Governance
UNDP সুশাসন নিশ্চিতকরণে কয়টি উপাদান উল্লেখ করেছে- ৯টি। ১। অংশীদারিত্ব ২। আইনের শাসন ৩। স্বচ্ছতা ৪। সংবেদনশীলতা ৫। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রাধান্য ৬। সমতা ৭। কর্যকরিতা ও দক্ষতা ৮। জবাবদিহিতা এবং ৯। কৌশলগত লক্ষ।
‘Power Corrupts, absolute Power tends to corrupt absolutely’ উক্তিটি বলেছেন- লর্ড এ্যাক্টন।
’যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই আইন’- এরিস্টটল।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়- সংবাদ মাধ্যমকে।
সুশাসন শব্দটি প্রথম সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে- UNDP
সুশিল সমাজ হচ্ছে- রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
সুশাসনের উপাদান/ বৈশিষ্ট: স্বচ্ছতা, দক্ষতা, বৈধতা, দায়িত্বশীলতা, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া, নৈতিক মূল্যবোধ, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
সুশাসনের অন্তরায়: আইনের শাসনের অভাব, বাক স্বাধীনতার অভাব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা ইত্যাদি।