January 20, 2025 10:09 pm
25310972
25310960

ব্যকরণ:

ব্যাকরণ কী?

ব্যাকরণ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। ব্যাকরণ ভাষার বিভিন্ন, দিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, ভাষার বিভিন্ন উপাদান ও সৌন্দর্যকে বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করে। অতএব বলা যায়, যে শাস্ত্র কোন ভাষার নিয়ম-শৃঙ্খলাে, উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরুপ, প্রয়োগবিধি, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য উদঘাটন ও বর্ণনা করে তাকে ব্যাকরণ বলে। যে শাস্ত্র বাংলা ভাষাকে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে তা বাংলা ব্যাকরণ এবং যে শাস্ত্র ইংরেজি ভাষাকে বর্ণনা করে তা English Grammar ।

ব্যাকরণের সংজ্ঞা:

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে, “ যে শাস্ত্র জানিলে বাঙ্গালা ভাষা শুদ্ধরুপ লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায় তাহার নাম বাঙ্গালা ব্যাকরণ।”

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে বিদ্যার দ্বারা কোনও ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া তাহার স্বরুপটি আলোচিত হয়, এবং সেই ভাষার পঠনে ও  লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শদ্ধ-রুপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।”

ড. সুকুমার সেনের মতে, ” যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরুপ ও প্রকৃতির বিচার ও বিশ্লেষণ  এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরুপে বলতে, লিখতে ও শিখতে পারা যায় তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ সংক্ষেপে বাংলা ব্যাকরণ বলে।

ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, “যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করিয়া ইহার বিবিধ অংশের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণন করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যকমত সেই নির্ণীত তত্ত ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হইয়া উঠে, তাহার নাম ব্যাকরণ।”

ব্যাকরণের প্রকারভেদ:

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ব্যাকরণ চার প্রকার। যথা:

১। বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ (Descriptive Grammar)

২। ঐতিহাসিক ব্যাকরণ (Historical Grammar)

৩। তুলনামূলক ব্যাকরণ (Comparative Grammar)

৪। দার্শনিক- বিচারমূলক ব্যাকরণ (Philosophical Grammar)

ড. এনামুল হকের মতে বাংলা ব্যাকরণ তিন প্রকার। যথা:

১। ঐতিহাসিক ব্যাকরণ,   ২। তুলনামূলক ব্যাকরণ ও   ৩। ব্যবহারিক ব্যাকরণ।

ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়:

প্রত্যেক ভাষার মৌলিক অংশ চারটি। যথা:

১। ধ্বনি (Sound),  ২। শব্দ (Word),  ৩। বাক্য (Sentence)  ৪। অর্থ (Meaning)

তাই সব ভাষার ব্যাকরণই প্রধানত নিন্মলিখিত চারটি বিষয়ের আলোচনা করে থাকে-

১। ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)

২। শব্দতত্ত্ব বা রুপতত্ত্ব (Morphology)

৩। বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম (Syntax)

৪। অর্থতত্ত্ব (Semantics)

এ ছাড়াও অভিধানতত্ত্ব (Lexicography), ছন্দ ও অলঙ্কার প্রভৃতি বিষয়েও ব্যাকরণ আলোচনা করে।

ধ্বনিতত্ত্ব:

ধ্বনি হল ভাষার মূল উপাদান বা ভিত্তি। মানুষের বাক প্রত্যঙ্গ যথ কণ্ঠনালি, মুখবিবর,জিহ্বা, তালু, দাঁত, মাড়ি, ঠোট ইত্যাদির মাধ্যমে উচ্চারিত আওয়াজকে বলা হয় ’ধ্বনি’। আর বাক প্রত্যঙ্গজাত ধ্বনির সুক্ষতম মৌলিক অংশ বা একককে বলে ধ্বনিমূল (Phoneme)। ধ্বনির উচ্চারণপ্রণালী, উচ্চারণের স্থান, ধ্বনির প্রতীক ও বর্ণের বিন্যাস, ধ্বনির পরিবর্তন ও লোপ, ধ্বনি সংযোগ বা সন্ধি ণত্ব ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

শব্দতত্ত্ব বা রুপতত্ত্ব:

এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবোধক সন্মিলনে তৈরি হয় শব্দ। আবার, শব্দের ক্ষুদ্রাংশকে বলা হয় রুপ (morpheme)। রুপ গঠন করে শব্দ। সেজন্য, শব্দতত্ত্বকে রুপতত্ত্ব বা Morphology বলে। এ অংশে শব্দরূপ, শব্দের গঠন, শব্দের প্রকার, উপসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি, বচন, লিঙ্গ, ধাতু, কারক, সমাস, ক্রিয়ার কাল, ক্রিয়ার ভাব, শব্দের ব্যুৎপত্তি ও অর্থগত পার্থক্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।

বাক্যতত্ত্ব:

বাক্যতত্ত্বকে বলা হয় পদক্রম। বাক্যের সঠিক গঠনপ্রণালী, বিভিন্ন উপাদানের সংযোজন, বিয়োজন, বাক্য-মধ্যে পদের স্থান বা ক্রম, পদের রুপ পরিবর্তন ইত্যাদি- এ অংশের আলোচ্য বিষয়।

অর্থতত্ত্ব:

অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ, যেমন- মুখ্যর্থ, গৌণার্থ, বিপরীতার্থ, শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার প্রভৃতি অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

ছন্দ-প্রকরণ:

সংস্কৃত ভাষায় ছন্দ শব্দের দুটি অর্থ। একটি অর্থ কাব্যের মাত্রা আরেকটি অর্থ ‘ইচ্ছা’। তাই মাত্রা-নিয়মের বিচিত্রতায় কাব্যের যে রুপটি ধ্বনি-রূপময় হয়ে উঠে তাই হলো ছন্দ। ছন্দ-প্রকরণ অংশে ছন্দের প্রকার ও নিয়মসমূহ আলোচনা করা হয়।

অলঙ্কার:

যার দ্বারা কাব্যর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় তাই অলঙ্কার। ব্যাকরণের এ অংশে উপমা, রুপক, অনুপ্রাস, শ্লেষ প্রভৃতি আলোচনা করা হয়।

কতিপয় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা:

মানোএল দা আস্ সুম্প্সাঁও (Manoel da Assumpcam):

বাংলা ব্যাকরণের প্রথম রচয়িতা মানোএল দা আস্ সুম্প্সাঁও। তিনি ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ভাওয়ালে পর্তুগীজ ভাষায় “ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পর্তুগীজ :দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস ’ (Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes) নামক প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। এটি ছিল ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার এবং বাংলা-পর্তুগীজ ও পর্তুগীজ-বাংলা শব্দাভিধান। গ্রন্থটি ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে মুদ্রিত হয়।

নাথানিয়েল ব্রাসি হেলহেড (Nathaniel Brassey Halhed):

তিনেই প্রথম বাংলা লিপি ও বাংলা অক্ষর ব্যবহার করে ‘এ গ্রামার অব দি বেঙ্গল লেঙ্গুয়েজ’ (A Grammar of the Bengal Language) নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটি ১৭৭৮ সালে হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়।

উইলিয়াম কেরি:

উইলিয়াম কেরি ছিলেন বাংলা গদ্যলেখক, বাংলা মুদ্রণের প্রবর্তক ও খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক। কেরি ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হন। রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রভৃতি দেশীয় পণ্ডিতদের নিয়ে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাাঁর গ্রন্থ ‘কথোপকথন’ (Dialogue,1801) এবং ’ইতিহাসমালা’ (১৮১২)।

রাজা রামমোহন রায়:

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। বাাঙ্গালি কর্তৃক রচিত প্রথম বাংলা ব্যাকরণ ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ গ্রন্থ রচনা করেন তিনি।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *